দাজ্জাল বিতর্কের আসল কারণ! ইহুদী, খৃস্টান ও ইসলামে এ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রামাতুল্লাহ।

প্রিয় দর্শক! আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন- গত কিছু দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে দাজ্জাল নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা এবং দাজ্জালের জন্ম ও আবির্ভাব নিয়ে চলছে নানা রকম তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলছেন- দাজ্জালের জন্ম হয়েছে হাজার বছর আগে এবং সে বর্তমানে এক নির্জন দ্বীপে বন্ধি আছে। কেউ বলছেন- শেষ যমানায় তার জন্ম হবে। কেউ নাকি তার আগমনের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আবার কেউ বলছেন- দাজ্জাল ধারণাটি একটি ভুয়া প্রচারণা।

কিন্তু আসল ব্যাপারটি কী? বিভিন্ন ধর্মে এ নিয়ে কী আছে- ওল্ড টেস্টামেন্ট, তালমূদ, বাইবেল, হাদিস ও গবেষণা গ্রন্থে গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা তা জানার চেষ্টা করেছি। সেসব আলোচনা ও বিতর্কের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি। আর এ নিয়ে ই আমাদের আজকের আয়োজন। আশা করি, রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর দারুন এ আলোচনায় শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে ই থাকবেন। তাহলে চলুন, এখনই মূল আলোচনা শুরু করা যাক।

  • দাজ্জাল আলোচনার সূত্রপাত :

প্রিয় দর্শক! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাজ্জাল নিয়ে বিস্তর আলোচনা দেখা যায়। অনেকে ধর্মগ্রন্থ থেকে বিভিন্ন বাণী ও কাহিনী শেয়ার করেন। ইহুদিরা ‘‘মাসিহ’’ এর আগমনের জন্য অপেক্ষায় আছেন এবং কোনো কোনো ইহুদি র‌্যাবাই তার সাথে যোগাযোগের দাবী করেন। খ্রিস্টানরা ‘‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’’ এর আগমন ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।

আর মুসলিমদের মধ্যে কেয়ামতের পূর্বে ‘‘মসিহুদ দাজ্জাল’’ এর আগমন ও ভূমিকা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে। এসব আলোচনার মূল সূত্র হলো ধর্মগ্রন্থের ভবিষ্যতবাণী। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থে শেষ যামানায় এক বিশেষ শক্তিমান সত্তার আগমনের কথা বলা হয়েছে। তার বিভিন্ন কাজ-কর্মের কথা রয়েছে। যা মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করবে এবং তাদেরকে নিজের অনুসারী বানিয়ে নেবে।

এসব বর্ণনার আলোকেই বিশেষজ্ঞগণ দাজ্জালের জন্ম, আবির্ভাব ও কর্মতৎপরতা নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ঐতিহাসিক দলিল, ইতিহাস বিশারদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত জানার আগে, ‘দাজ্জাল’ ধারণাটির উৎপত্তি সম্পর্কে খোঁজখবর করা যাক।

  • খ্রিস্টপূর্ব সময়ে দাজ্জালের ধারণা :

প্রিয় দর্শক! খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকে কয়েকটি ঘটনা ইহুদিদের হতবিহ্বল করে ফেলেছিল। যেমন:  ব্যাবিলনীয়দের জেরুজালেম দখল, সলোমনের মন্দির ধ্বংস এবং এর ধারাবাহিকতায় ইহুদিদের নির্বাসন।

অনেকে এই ঘটনাগুলোকে একটি দুর্ভাগ্যের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এগুলোকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, গড অব ইসরায়েল, ইসরায়েলিদের ঈশ্বর বা যিহোবা তাদের পরিত্যাগ করেছেন। শাস্তি হিসেবে তাদের পবিত্র উপসনালয় ধ্বংস হয়েছে এবং তারা ‘‘প্রমিজ ল্যান্ড’’ বা প্রতিশ্রুত ভূমি থেকে উৎখাত হয়েছেন। কিন্তু, যিহোবা তাদের ওপর চিরকাল ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন না। সাময়িক শাস্তির পর তারা পরিত্রাণ পাবেন- এই বিশ্বাসও ছিল ইহুদিদের। মসিহ হিসেবে কোনো রাজা আসবেন, যার অধীনে তাদের নবজাগরণ ঘটবে।

ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী, ডেভিডের বংশানুক্রম থেকেই একজন পরাক্রমশালী রাজার আবির্ভাব হবে। সেই রাজা বিশ্বে ইহুদি শাসন পুনঃস্থাপন করবেন বলে তাদের আশা। যে প্রভাবশালী রাজা ও নবীর ওপর ইহুদি প্রার্থনা সঙ্গীত- ‘‘সাম’’ নাজিল হয়েছিল নতুন রাজাও তেমনই হবেন।

গবেষণা থেকে জানা যায়, এই বিশ্বাসের ভিত্তি এসেছে নবী দানিয়েলের কাছ থেকে। ইহুদিদের ব্যবিলনে নির্বাসিত থাকার সময়কালে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দানিয়েলের ওই রচনা বর্তমান বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের অংশ। এর একটি অনুচ্ছেদ হলো : ‘‘নেভিম’’। হিব্রু ভাষায় নেভিম শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘‘নবী’’ বা পয়গম্বর। অনুচ্ছেদটিতে সেই সময়কালের আগের ও পরের নবীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে লেখা আছে : “রাতে স্বপ্নে দেখলাম, আমার সামনে এক মানব সন্তান দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে আছে স্বর্গীয় মেঘমালা। তিনি যিহোবার সন্নিকটে গেলেন। তাকে ভূষিত করা হলো মর্যাদা ও কর্তৃত্বে। স্রষ্টার রাজত্বের সবকিছু তার ওপর ন্যস্ত করা হলো। সকল ভাষা, সকল জাতি-গোষ্ঠীর মানুষেরা তার অধীনস্ত। চিরস্থায়ী তার শাসনকাল।”

  • খৃস্টধর্মে দাজ্জালের ধারণা :

ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর যিশুর পুনরুত্থান হবে এমন বিশ্বাস ‘‘গসপেল’’ বা খ্রিস্টান ধর্মকথা এবং নিউ টেস্টামেন্ট বা বাইবেলের একাংশ সহ অন্যান্য বইয়েও লিপিবদ্ধ আছে। যেমন: বাইবেলের শেষ পুস্তক, ‘‘জন’স রিভেলেশন’’ বা বুক অব রিভেলেশনে বলা হয়েছে- “যিশু খ্রিস্টের তরফে, যিনি বিশ্বস্ত সাক্ষী, মৃতদের মধ্য থেকে প্রথম জন্ম লাভকারী এবং পৃথিবীর রাজাদের শাসক।”

নিউ টেস্টামেন্টের শেষের দিকে লেখা অন্য একটি অনুচ্ছেদে বলা আছে : “এ জগত আমাদের প্রভু এবং তার খ্রিস্টের রাজ্যে পরিণত হবে এবং তিনি চিরকালের জন্য রাজত্ব করবেন।” অতএব, উভয় ধর্মের অনুসারীরাই পৃথিবীর শেষ সময়ের আগে ‘‘মেসিয়ানিক যুগ’’ বা মসিহের আগমনের প্রত্যাশা করেন।

  • ইসলামে দাজ্জালের ধারণা :

প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন : নিশ্চই আমি তোমাদেরকে (দাজ্জালের) ব্যাপারে সতর্ক করছি। আর এমন কোনো নবী নেই যিনি তাঁর কওমকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেননি। এমনকি নূহ আ.ও তাঁর কওমকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। তবে তার সম্পর্কে আমি এখন তোমাদেরকে এমন কথা বলবো, যা কোনো নবী তাঁর কওমকে বলেননি। জেনে রেখো! সে নিজকে বিশ্ব জাহানের প্রভু দাবী করবে। অথচ সে হবে এক চোখ অন্ধ ব্যাক্তি। আর নিশ্চই তোমাদের প্রকৃত প্রভু- আল্লাহ অন্ধ নন। [সহিহ বুখারী : ৩০৫৭]

সহিহ বুখারীর এ হাদিসের মত আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে। যেগুলোর ওপর নির্ভর করে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, কেয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং যিশু বা ঈসা ইবনে মারয়াম আ. এরও আবির্ভাব হবে। তবে তাঁর এই আবির্ভাব হবে- আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সা. এর উম্মত বা অনুসারী হিসেবে। অবশ্য, ইবনে খালদুনের মতো দু’য়েকজন ইসলাম বিশারদ দাজ্জালের আবির্ভাব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

যেমন : পাক-ভারত উপমহাদেশের কোনো এক বিপ্লবী রাষ্ট্রচিন্তা নায়ক বলেন : দাজ্জাল এবং ইমাম মাহদি বিষয়ে আল-কুরআনে কোনো বর্ণনা পাওয়া যয় না। কেবল কিছু হদিসে এ নিয়ে জটিল আলোচনা দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায়- দাজ্জাল এবং ইমাম মাহদি বলতে কেউ নেই।

  • অ্যান্টিক্রাইস্ট ধারণা :

প্রিয় দর্শক! দাজ্জাল ও যিশু খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের অভিমতগুলো তো জানা হলো। এবার তাহলে অ্যান্টিক্রাইস্ট বা যিশু খ্রিস্ট বিরোধি দাজ্জালের ধারণা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

খ্রিস্টের ঠিক বিপরীত ধারণা হলো : অ্যান্টিক্রাইস্ট মতবাদ। যার অর্থ হলো যিশুর চূড়ান্ত শত্রু। খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য অনুসারে, শেষ বিচারের পূর্ববর্তী সময়টাতে তার এক ভয়ানক রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

রবার্ট ই. লার্নার নামে একজন গবেষক ‘‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার’’ জন্য গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, অ্যান্টিক্রাইস্ট শব্দটি প্রথম উল্লেখ করা হয় জন’স রিভেলেশনে। জন’স রিভেলেশন বাংলাভাষী খ্রিস্টানদের কাছে সাধু জন বা যোহনের সুসমাচার নামেও পরিচিত। আর তার জীবন ও রাজত্বের বর্ণনা মেলে মধ্যযুগীয় গ্রন্থগুলোতে।

লার্নার বলেন, “খ্রিস্টানদের মধ্যে দাজ্জাল এর ধারণাটি এসেছে ইহুদি ধর্মশাস্ত্র থেকে। বিশেষ করে হিব্রু বাইবেলের ‘‘দ্য বুক অব দানিয়েল’’ থেকে এর উৎপত্তি।” খ্রিস্টপূর্ব ১৬৭ সালের দিকে লেখা বইটিতে এক চূড়ান্ত অত্যাচারীর আগমনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। “যিনি সময় এবং বিধি-বিধান পাল্টে দিতে চেষ্টা করবেন। ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ করবেন, হামলে পড়বেন বিশ্বাসীদের ওপর।”

পণ্ডিতরা একমত যে, ড্যানিয়েলের লেখায় ফিলিস্তিনের তৎকালীন হেলেনিস্টিক শাসক- অ্যান্টিওকাস চতুর্থ এপিফেনাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল। যিনি ইহুদি ধর্মকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অ্যান্টিওকাসের নামের উল্লেখ না থাকায় পরবর্তীতে যে কোনো অত্যাচারীর জন্যই ড্যানিয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীটি প্রযোজ্য।

লার্নার আরও বলেন : শুরুর দিকের খ্রিস্টানরা এটিকে রোমান সম্রাটদের বেলায় ব্যবহার করত। কারণ তারা গির্জাগুলোর ওপর খড়গহস্ত ছিল। বিশেষ করে ৫৪ থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করা সম্রাট নিরোর  কথা উল্লেখ করেন লার্নার। সেই সময়কার খ্রিস্টানরা এক প্রতাপশালী অ্যান্টিক্রাইস্টের আগমনের কথাই জোর দিয়ে বলতেন।

জন’স রিভেলেশন বা রিভেলেশন টু জন এ যাকে ‘‘অতল থেকে উঠে আসা পশু” এবং ‘‘সমুদ্র থেকে উঠে আসা পশু’’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার আবির্ভাবের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিবরণ হলো নিউ টেস্টামেন্টের থিসালোনিয়ানস। যেখানে তাকে ‘‘পাপের মানুষ’’ এবং ‘‘ধ্বংসের পুত্র’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সাধারণের মধ্যে যখন ধর্মত্যাগের প্রবণতা বেড়ে যাবে তখন তার আগমন ঘটবে। বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ এবং বিস্ময়কর ঘটনার ছলনায় ফেলবেন মানুষকে। তারপর ঈশ্বরের মন্দিরে গিয়ে বসবেন এবং নিজেকেই ঈশ্বর বলে দাবি করবেন। শেষ পর্যন্ত, যিশুর কাছে পরাজিত হতে হবে তাকে। যিশুর ‘‘মুখমণ্ডলের জ্যোাতির্ময় তেজ’’ এবং ‘‘তার আবির্ভাবের উজ্জ্বলতায়’’ ধ্বংস হবেন অ্যান্টিক্রাইস্ট।

অ্যান্টিক্রাইস্টের প্রতি মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়- অ্যাডসো, রিপেলিন এবং অন্যান্য লেখকদের রচনা থেকে। মূলত ওই বার্তাটিই প্রকাশিত হয়- সে খ্রিস্টের বিপরীতে এক মিথ্যার নাম। তাদের থেকে লার্নার এই উপসংহারে পৌছেছেন যে,  “খ্রিস্ট বা ক্রাইস্টের মতো অ্যান্টিক্রাইস্টের অনেক অনুসারী হবে। নানা অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে তাদের মোহাবিষ্ট করে রাখবেন সে। আর তার রাজত্ব স্থায়ী হবে সাড়ে তিন বছর।

মধ্যযুগীয় তথ্যসূত্রগুলোর বয়ান অনুযায়ী, “খ্রিস্টের মতো, অ্যান্টিক্রাইস্টও জেরুজালেমে আসবেন। কিন্তু তার বেলায় যিশুর সাথে যা ঘটেছিল তার উল্টোটা ঘটবে। তার আগমনে উচ্ছসিত হয়ে ইহুদিরা তাকে সমাদর ও সম্মানিত করবে।” শাসনভার গ্রহণের পর তিনি সেই মন্দিরটি পুননির্মাণ করবেন এবং সলোমনের সিংহাসনে আরোহণ করবেন।

পৃথিবীর শাসকেরা তার প্রতি আনুগত্য জানাবে। সে তাদেরকে নিজ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করবে। ভয়াবহ নিপীড়ন চালাবে খ্রিস্টানদের ওপর। পৌরহিত্য এবং রাজত্বে ন্যায়পরায়ণতার উল্টো পিঠ দেখবে সবাই। যারাই তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে তারাই অত্যাচারের শিকার হবেন।

‘‘গসপেল অব ম্যাথিউ’’ বা মথি লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়- যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তখন ‘‘মহা দুর্ভোগ’’ নেমে আসবে। যা পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে যাই হোক না কেন, নির্ধারিত সাড়ে তিন বছর শেষে খ্রিস্টের শক্তির দ্বারা ধ্বংস হবে অ্যান্টিক্রাইস্ট।  তারপর, অল্প সময়ের ব্যবধানে আসবে শেষ বিচারের দিন ও বিশ্বের শেষ দিন।

পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টের বিরুদ্ধে যায়- এমন যেকোনো কিছুকেই অ্যান্টিক্রাইস্ট হিসেবে সাব্যস্ত করার একটা প্রবণতা তৈরি হয় বলে জানান মি. লার্নার। এমনকি হাল আমলে ক্রেডিট কার্ড বা ইলেকট্রনিক বারকোডে ৬৬৬ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিরীহ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অ্যান্টিক্রাইস্ট ভেবে থাকেন কেউ কেউ। কারণ, বাইবেলে এটিকে সেই শয়তানের সংখ্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত বছরের জুনে বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পোল্যান্ডে ৬৬৬ বলে পরিচিত একটি বাসরুটের কোড পরিবর্তন করে ৬৬৯ করা হয়েছে- ধর্মীয় রক্ষণশীলদের অভিযোগের কারণে।

  • দাজ্জালের আধিপত্য বিস্তারের কৌশল :

প্রিয় দর্শক! দাজ্জালের আধিপত্য বিস্তারের কৌশল বুঝতে হলে প্রথমে দাজ্জাল শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জানা দরকার।  মূলত ‘‘দাজ্জাল’’ শব্দটি একটি নামবাচক বিশেষণ।  যা প্রতারণা, সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ বা ব্যাপকভাবে প্রতারণাকে বোঝায়। এ অর্থেই কেয়ামতের পূর্বে আগত ব্যক্তিকে ‘‘মসিহুদ দাজ্জাল’’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মূল কথা হলো যিশু বা ঈসা আবনে মারয়াম আ. এর প্রত্যাবর্তনের আগে কেউ একজন নিজেকে যিশু বলে মিথ্যা দাবি তুলবে।

ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে ‘‘মসিহ আগমনের প্রত্যাশা’’কে কাজে লাগিয়ে সে কৌশলে মানুষকে প্রতারিত করবে। কিছু হাদিসে বলা হয়েছে, দাজ্জালের এক চোখ অন্ধ হবে। বিশ্বাসীরা তার ছলনা স্পষ্টই বুঝতে পারবেন এবং তাকে একজন ‘কাফের’ হিসেবেই চিহ্নিত করবেন।

অর্থাৎ, দাজ্জাল বলতে এমন একজন প্রতারককে বোঝায় যে মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, অনন্য গুণসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার পরিবর্তে যে বিভেদ সৃষ্টি ও অপকর্ম করে বেড়াবে। দাজ্জাল প্রথম দিকে সহিংসতার মাধ্যমে তার লক্ষ্য অর্জন করবে না। বরং প্রতারণা শক্তি, বুদ্ধি ও উচ্চতর প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করবে। দাজ্জাল জ্ঞান এবং প্ররোচনামূলক যুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। অবশেষে পরিস্থিতি এমন হবে যে, কেউ মানুষের উপর দাজ্জালের চেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না।

দাজ্জালের চেহারার বর্ণনায় বলা হয়েছে “তার কপাল চওড়া হবে, চুল কোঁকড়ানো এবং চোখ থাকবে একটি। অন্য চোখটি ফোলা আঙুরের মতো বেরিয়ে থাকবে। প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী হবে দাজ্জাল।” “তার আচার-আচরণ হবে খুবই কুৎসিত। সেসবের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে প্রতারণার মধ্য দিয়ে।”

  • দাজ্জাল আবির্ভাবের স্থান :

“বিশ্বাস করা হয়- দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে খোরাসানে। অঞ্চলটির বিস্তার ইরাক থেকে ভারতের সীমানা পর্যন্ত ধরা হয়, যার মধ্যে ইসফাহানও অন্তর্ভুক্ত।” ‘‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার’’ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চল, তুর্কমেনিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল ও আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ঐতিহাসিকভাবে খোরাসান হিসেবে বিবেচিত হতো। “তার অনুসারীদের মুখমণ্ডল হবে ইয়াজুজ-মাজুজের মতো চওড়া।”

“দাজ্জাল পূর্ব দিক থেকে তার গন্তব্য মদিনায় পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু, উহুদ পর্বত পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তাকে থামতে হবে। পর্বতের প্রতিবন্ধকতায় আর সামনে এগোতে পারবে না। পরবর্তীতে, ফেরেশতারা তার গতিপথ পাল্টে সিরিয়ার দিকে নিয়ে যাবে। যেখানে তার অন্তিম পরিণতি ঘটবে।”

এ কারণে, আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সা. দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিস্তার পেতে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছিলেন এবং তার উম্মতদেরও একই রকম প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছেন। যেমন: সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে রয়েছে- রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন : আদি পিতা আদম আ. এর সৃষ্টি থেকে কেয়ামত কায়েম হওয়া পর্যন্ত সময়ের মাঝে দাজ্জালের চাইতে বড় ও ভয়ানক ফিতনাবাজ আর কোনো সৃষ্টি নেই।  [সহিহ মুসলীম : ৫২৩৯। মুসনাদ আহমদ : ১৫৮৩১]

দাজ্জাল যখন শেষ বিচার বা কেয়ামতের কাছাকাছি সময়ে আবির্ভূত হবে তখন ঈসা আ. তাকে পরাজিত করবেন। মুসলমানরা একে অন্য সব ঐশ্বরিক ধর্মের ওপর তাদের একটা বিজয় হিসেবে দেখে।  ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের মতে, তখন অধার্মিক রাজার রাজত্বের অবসান ঘটবে। বুক অব দানিয়েলে বলা হয়েছে : “এর পরের ঘটনাগুলো ঐশ্বরিকভাবে ফয়সালা হবে এবং ওই রাজার আধিপত্য কেড়ে নেওয়া হবে।” “তার সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তারপরে ঈশ্বরের পবিত্র মানুষেরা এই রাজ্য পরিচালনা করবে।”

খ্রিস্টানদের মতে, অ্যান্টিক্রাইস্টের পরাজয়ে নিরঙ্কুশ হবে খ্রিস্টের চিরন্তন শ্রেষ্ঠত্ব। অসংখ্য খ্রিস্টান পণ্ডিত ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং এই অঞ্চলে এর আধিপত্যকে সেই ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা হিসেবেই ব্যাখ্যা করে থাকেন। মুসলমানরাও সাধারণত ঐতিহ্যগতভাবে একই ধারণা পোষণ করেন। এ কারণেই যুগে যুগে দাজজাল নিয়ে থেরি হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। তবে আল্লাহ তায়ালা বলেন :

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي ۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ۚ

‘(মানুষ) আপনাকে জিজ্ঞেস করে- কেয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? বলে দিন এর জ্ঞান  তো কেবল আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তিনিই তা অনাবৃত করে দেখাবেন। আসমান ও যমীনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয়। যখন তা তোমাদের উপর আসবে- অজান্তেই এসে যাবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ বিশেষভাবে কেবল আল্লাহর নিকটই রয়েছে। কিন্তু তা অধিকাংশ লোকই তা উপলব্ধি করে না।’ [সূরা আরাফ, ৭: ১৮৭]

সুতরাং, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কেয়ামতের পূর্বের নানা ঘটনা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন।  বরং নিজ কেয়ামত তথা মৃত্যুর জন্য নেক আমলের মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন, আমীন!

Facebook
WhatsApp

কন্টেন্টটি ব্লক করা আছে, অনুগ্রহ করে এডমিনের সাথে যোগযোগ করুন।